নিউজ ডেস্ক : পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দেশের সড়ক, রেল ও নৌপথে নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রা নিশ্চিত করতে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। ঈদের আগাম টিকিট নিয়ে এবার সমস্যা কম; তবে অতিরিক্ত ভাড়ার অভিযোগ উঠেছে। ৯ দিনের ছুটিতে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের বাড়ি ফেরার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। সড়কে যানবাহনের চাপ সামালসহ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুত রয়েছে প্রশাসন।
পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে এবার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আগামী ২৮ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ৯ দিন ছুটি থাকছে। পরিবহন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার ঈদের ছুটি বাড়ানোয় লাখ লাখ মানুষের সড়ক, রেল ও নৌপথে ঈদযাত্রায় একসঙ্গে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ কমবে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ৩১ মার্চ পবিত্র ঈদুল ফিতর হতে পারে। সে হিসেবে ২৯ মার্চ ঈদুল ফিতরের ছুটি শুরু হওয়ার কথা। তার আগের দিন ২৮ মার্চ সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার এবং একই দিন পবিত্র শবেকদরের ছুটি।
বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) এক দিন অফিস খোলা। তার আগের দিন ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের ছুটি রয়েছে। এক দিন ছুটি নিয়ে ২৫ মার্চ থেকে অনেকে নাড়ির টানে বাড়িমুখো হবেন। আবার ঈদের ছুটি শেষে ৩ এপ্রিল অফিস খোলার কথা থাকলেও বর্ধিত ছুটির কারণে ৫ এপ্রিল অফিস খুলবে। ঈদের আগে-পরে মিলিয়ে টানা ৯ দিন ছুটি ভোগ করবেন প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী।
এদিকে, পোশাকশিল্পেও ঈদের দু-তিন দিন আগে শ্রমিকদের ছুটি দিতে কারখানা মালিকদের অনুরোধ করেছে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। ম্যাপড ইন বাংলাদেশের (এমআইবি) তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে তিন হাজার ৫৫৫টি রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা আছে, যাতে কাজ করেন ৩০ লাখ ৫৩ হাজার শ্রমিক। এতে এবার ঈদযাত্রায় একসঙ্গে সড়ক, রেল ও নৌপথে যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ পড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, টানা ৯ দিন ছুটির কারণে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনেকে ঢাকা ছাড়ার পর পোশাকশিল্পের সাড়ে ৩০ লাখ শ্রমিকের ঘরমুখো হওয়া শুরু হবে। সে সঙ্গে অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও যাত্রীর কারণেও সড়কে প্রভাব পড়বে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যমুনা নদীর ওপর নির্মিত রেলসেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় গত মঙ্গলবার। ঈদযাত্রা উপলক্ষে আরো করেকটি নতুন সেতু ও সড়ক খুলে দেওয়া হয়েছে। যানজট নিরসন, যাত্রীর নিরাপত্তা, টিকিটের অতিরিক্ত দাম ও টিকিট কালোবাজারি বন্ধসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। অন্যবারের মতো বিড়ম্বনা লাঘবে তিন হাজার ৯৯১ কিলোমিটার মহাসড়কে এক হাজার ১৮টি চেকপোস্ট ও টহলে থাকবেন হাইওয়ে পুলিশসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সদস্য।
ঈদ উপলক্ষে ২৫ মার্চ থেকে ‘ঈদ স্পেশাল সার্ভিস’ চালু করবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। ২০ মার্চ থেকে বিআরটিসির ডিপো থেকে অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে এবং আগামী ৫ এপ্রিল পর্যন্ত ঈদ সার্ভিসের বাস চলাচল করবে। সঙ্গে বাস রিজার্ভের সুবিধাও রেখেছে বিআরটিসি।
যাত্রীদের সেবা নির্বিঘ্ন করতে ঈদযাত্রার বহরে নতুন বাস যুক্ত করেছে বেসরকারি অপারেটররা। নির্ধারিত দামের অতিরিক্ত দামে টিকিট বিক্রি, যাত্রী হয়রানি ও বাসের শিডিউল বিপর্যয় রোধে পুলিশের পাশাপাশি মাঠে থাকবেন বাস মালিক সমিতির সদস্যরা। বাসের শিডিউল বিপর্যয় হলে যাত্রীদের তাৎক্ষণিকভাবে তা জানাতে হেল্প সেন্টার চালু করেছে দেশের টিকিট বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকম।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এসি ও নন-এসি বাসের বাইরেও স্লিপার ও বিজনেস ক্লাস স্যুট বাস ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে সেবা দিয়ে থাকলেও এবার ঢাকা-উত্তরবঙ্গ রুটেও সেবা প্রদান করবে। বুড়িমারী এক্সপ্রেস, হেরিটেজ ট্রাভেলস, শান্ত ট্রাভেলস, শাহ আলী পরিবহন তাদের বহরে বিলাসবহুল বাস যুক্ত করেছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন সড়কে সেবা প্রদানকারী বাস কোম্পানিগুলোও তাদের বহরে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করছে।
হানিফ পরিবহনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সিরাজুল ইসলাম রিকু জানান, এবার বিভিন্ন রুটে ৬০টি নতুন বাস যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি উন্নতমানের মার্সিডিজ বেঞ্জের গাড়ি রয়েছে। তবে কোনো রুটেই ঈদ উপলক্ষে ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়নি।
অনলাইনে টিকিট বিক্রি করছে বিডি টিকিটস, সহজযাত্রী, পরিবহনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। বাস, রেল ও লঞ্চের টিকিট সেবা প্রদান করা সহজ ডটকমের এক কর্মকর্তা জানান, তারা সব মিলিয়ে এবার ঈদযাত্রায় ৩০ লাখ টিকিট বিক্রির প্রত্যাশা করছেন। সফটওয়্যারের মাধ্যমে টিকিট বিক্রি হওয়ায় অতিরিক্ত দামে কোনো অপারেটর টিকিট বিক্রি করতে পারছে না। যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে বাসের রিয়েল টাইম আপডেট ও হেল্প সেন্টার চালু করা হয়েছে।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও ফিটনেসবিহীন বাস চালানো বন্ধে সোচ্চার হওয়ার কথা জানিয়েছে বাস মালিক সমিতি। তারা বাস মালিকদের সঙ্গে সভা করে এ ব্যাপারে একমত হওয়ার পাশাপাশি এ বিষয়ে পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছে। এ ছাড়া যাত্রী হয়রানি বন্ধ ও বাসের শিডিউল দেরি না করতে বাস মালিক সমিতির হেল্প ডেস্ক করার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম জানান, এবার যাত্রীদের নিরাপদ ও সুন্দর ঈদযাত্রা নিশ্চিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাস কাউন্টারগুলোর সামনে নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা টাঙানো, প্রতিটি টার্মিনালে যাত্রীদের জন্য হেল্প ডেস্ক রাখা, যাত্রী হয়রানি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্য থাকা এবং ভোরে ও রাতে যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে টার্মিনাল এলাকায় পুলিশের টহল বাড়ানো।
শনিবার রাতে মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বিআরটিএ সংস্থাপন শাখার এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে ঈদের আগে-পরে সাতদিন মহাসড়কে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও লরি চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে এ সময় জরুরি নিত্যপণ্যবাহী গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক থাকবে। গত ৯ মার্চ সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঈদ উপলক্ষে আগামী ২৫-২৮ মার্চ পর্যন্ত এবং ঈদের পর ৩ দিন মহাসড়কে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও লরি চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, পচনশীল দ্রব্য, গার্মেন্ট সামগ্রী, ওষুধ, সার ও জ্বালানি বহনকারী যানবাহন এর আওতামুক্ত থাকবে।
জানা গেছে, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করতে সারা দেশে সড়ক-মহাসড়কে এবার কাজ করবে পুলিশ। ঢাকার মূল সড়কগুলোয় ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকবে। দেশের তিন হাজার ৯৯১ কিলোমিটার মহাসড়কে নিরাপত্তা জোরদারকরণে হাইওয়ে পুলিশ ৩৭৭টি চেকপোস্ট, জেলা পুলিশ ১১৪টি চেকপোস্ট ও ৫২৭টি টহল দল পরিচালনা করবে। যানজট নিরসনে সারা দেশে ৬৪টি ‘ব্ল্যাক স্পট’ চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে পুলিশের অতিরিক্ত সদস্য উপস্থিত থাকবেন। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও যান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
গতকাল রোববার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তিতে বেশকিছু ট্রাফিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, গত ৯ মার্চ সভার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ২৫ মার্চ হতে ঈদের পূর্ব রাত পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করবে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশ। এ সময়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক (এয়ারপোর্ট-আব্দুল্লাহপুর), ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (যাত্রাবাড়ী-সাইনবোর্ড), পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে (৩০০ ফিট সড়ক), ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক (মিরপুর রোড : শ্যামলী-গাবতলী), ঢাকা-কেরানীগঞ্জ সড়ক (ফুলবাড়িয়া-তাঁতীবাজার-বাবুবাজার ব্রিজ), ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক (যাত্রাবাড়ী-বুড়িগঙ্গা ব্রিজ), মোহাম্মদপুর বসিলা ক্রসিং হতে বসিলা ব্রিজ সড়ক, আব্দুল্লাহপুর-ধউর ব্রিজ সড়কে ঈদযাত্রার যান ব্যতীত অন্যান্য যানবাহনকে বিকল্প সড়ক ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
এদিকে, গতকাল রোববার এক বিবৃতিতে ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। বিবৃতিতে তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও প্রকাশ্যে বিভিন্ন শ্রেণির বাস ও লঞ্চে নানান কায়দায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। বিআরটিএ, বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে যাত্রীপ্রতিনিধি ছাড়া কেবল বাস ও লঞ্চমালিকদের নিয়ে স্বৈরাচারী কায়দায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায় মনিটরিংয়ে ভিজিলেন্স টিম গঠন করা হয়েছে।
যাত্রীর স্বার্থ দেখবে কে- এমন প্রশ্ন রেখে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সড়কে চাঁদা কমেছে। তবে ভাড়া না কমায় যাত্রীরা সুফল থেকে বঞ্চিত। এবারের ঈদে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন রুটে এসি-ননএসি বাসে ৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন রুটের বাসে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, বগুড়া, নওগাঁ, পঞ্চগড়, ঠাঁকুরগাঁও থেকেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের তথ্য পাওয়া গেছে।
এছাড়া ঢাকার সদরঘাট নৌবন্দর থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে অতিরিক্ত ভাড়ায় ঈদের অগ্রিম টিকিট মিলছে। আকাশপথে ঢাকা-সৈয়দপুর, ঢাকা-কক্সবাজার, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ রুটে ভাড়া ডাকাতি চলছে। তিনি ঈদযাত্রায় সব পথে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।