নিউজ ডেস্ক : সাগরে ব্লক তৈরি করে রানওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে কক্সবাজার বিমানবন্দরে। দেশে এটাই প্রথমবারের মতো এ ধরনের উদ্যোগ। সরকারের লক্ষ্য বিমানবন্দরটিকে বিমান চলাচলের আঞ্চলিক হাব হিসেবে গড়ে তোলা। সমুদ্রের নীল জলরাশি ভেদ করে কক্সবাজারে অবতরণ করবে আধুনিক বিশালাকৃতির উড়োজাহাজ। সম্প্রসারিত হতে যাওয়া ১৭০০ ফুট রানওয়ের ১৩০০ ফুটই থাকবে সাগরের পানির মধ্যে।
তবে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ কাজে পদে পদে বাধা আসছে। প্রকল্প নকশা অনুযায়ী বিমানবন্দর সম্প্রসারণে বড় বাধা ৪ দশমিক ৬৪ একর জমি অধিগ্রহণ করতে না পারা। এ ছাড়া অধিগ্রহণকৃত ৯৭ একর জমিতে বসবাসরত ৩ হাজার ৩০০ পরিবারও জায়গা ছাড়তে নারাজ। নানা উদ্যোগ নিয়েও তাদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। প্রকল্পটি সময়মতো শেষ করা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
এ বিষয়ে সিভিল অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া বলেন, আমরা সিভিল প্রশাসনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। দেশে এই প্রথমবারের মতো সমুদ্রের ভেতরে ব্লক তৈরি করে রানওয়ে সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। এখানকার ৬৮২ একর জায়গা সিভিল অ্যাভিয়েশনের। সংস্থাটির জায়গাতেই স্থানীয়রা অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করেছে। স্থানীয়দেরও অন্যত্র পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছি আমরা । যাতে তাদের কোনো সমস্যা না হয়। কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে হবে দেশের সবচেয়ে বড় রানওয়ে। উড়োজাহাজের উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য রানওয়ের দেই পাশে কমপক্ষে ৫০০ থেকে ৬০০ ফুট খালি জায়গা রাখতে হবে।
সম্প্রতি বিমানবন্দরটি পরিদর্শনে যান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় সারসংক্ষেপটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বর্তমানে কক্সবাজার বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি যাত্রীবাহী এবং ৬ থেকে ১০টি কার্গো বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। যাত্রীদের চাপ বেড়ে যাওয়ায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিমানবন্দরটি রিজিওনাল হাব হিসেবে গড়ে তুলতে দিনরাত পূর্ণ সক্ষমতায় বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ নিশ্চিতকরণের জন্য ‘কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সম্প্রসারণ’ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে নানা বাধা এসেছে। বিশেষ করে বিমানবন্দরের আশপাশে বসতভিটা থাকায় সমস্যা তৈরি হয়েছে। ফলে জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিমানবন্দরের অনুকূলে বন্দোবস্তকৃত ভূমি হতে পুরোনো ঝিনুক মার্কেটের ১৪টি দোকান ও বস্তিসহ ৪২ পরিবারকে অপসারণ করা যাচ্ছে না। বিমানবন্দরের অনুকূলে ঝিনুক মার্কেট এলাকায় অবশিষ্ট ০.০৪ একর জমি অধিগ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না।
অন্যদিকে বিমানবন্দরের ৪.৫৬ একর জমিতে স্থিত গণপূর্ত এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের স্থাপনা অপসারণ না হওয়ায় জমিটি অধিগ্রহণ করা যাচ্ছে না।
সারসংক্ষেপে আরো বলা হয়, বিমানবন্দরের অপারেশনাল এলাকার অভ্যন্তরে সেনাবাহিনী কর্তৃক দাবিকৃত ৬.৫৭ একর জমির মধ্যে ৪.৬৪ একরে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে বাধা দেওয়ায় ফায়ার স্টেশন ভবন, ড্রেনেজ, পেরিফেরিয়াল রোড ও সিকিউরিটি বাউন্ডারি ওয়াল প্রভৃতি নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিমানবন্দরের অনুকূলে ৬৮২ একর জমির মধ্যে ৯৭ একরে ৩৩০০ পরিবারকে উচ্ছেদ করা যায়নি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সমুদ্রে রানওয়ের কাজ ৯৬ ভাগ শেষ হয়েছে। বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে ৯৪ ভাগ। সমুদ্রে ২২০০ ফুট দৈর্ঘ্য প্রিসিশন এপ্রোচ লাইট স্থাপনসহ মেইন্টেন্যান্স স্ট্রিল ব্রিজ নির্মাণের কাজ হয়েছে ৮৩ শতাংশ। রানওয়ের চারপাশে নিরাপত্তা সীমানাপ্রাচীর ও নিরাপত্তা টহল রাস্তা নির্মাণের কাজ হয়েছে ২৬ শতাংশ। রানওয়ের চারপাশে ড্রেনেজ সিস্টেম নির্মাণের কাজ হয়েছে ৫৫ শতাংশ। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ যাত্রী চলাচল বৃদ্ধি পাবে। বৈদেশিক বিনিয়োগের পাশাপাশি পর্যটন খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের জিডিপি বৃদ্ধি তথা দারিদ্র্য হ্রাসে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখবে।
এ বিষয়ে বেবিচকের এক কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজার সমুদ্রতীর ঘেঁষে অত্যাধুনিক এজিএল সিস্টেম তৈরি করা হবে, যা রাতের অন্ধকারে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় দেখা দেবে অনন্য এক নৈসর্গিক দৃশ্য। মনোমুগ্ধকর নির্মাণশৈলীতে সাজানো হয়েছে গোটা এয়ারপোর্টের ড্রয়িং ডিজাইন। এয়ার ফিল্ড লাইটিং সিস্টেম, সমুদ্রের জলাবদ্ধতা রক্ষা, সমুদ্র পুনরুদ্ধার, নমনীয় ফুটপাত, সমুদ্রে যথাযথ পদ্ধতিতে আলোক ব্যবস্থার মতো দৃষ্টিনন্দন বস্তুর সমাহার থাকছে এখানে। সমুদ্রতীরবর্তী রানওয়েতে ওঠানামা করবে পৃথিবীর সব বিশালাকৃতির উড়োজাহাজ।
তিনি আরও বলেন, গত বছর প্রকল্পের রানওয়ে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ধীরগতিতে চলছে রানওয়ে নির্মাণ, রানওয়ের স্ট্রেনদেনিং বাড়ানো, ট্যাক্সিওয়ে নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে পুনর্বাসনে পাশের বাকখালী আশ্রয়ণ প্রকল্পে যাতায়াতের জন্য সেতু নির্মাণসহ বেশকিছু কাজ। প্রকল্প এলাকার কিছু জমি নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার এখনো সমাধান হয়নি। রাত্রিকালীন ফ্লাইট চালু করতে না পেরে বিপুল রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
রানওয়ের চারপাশে ড্রেনেজ সিস্টেম নির্মাণ করা হয়েছে ৫৫ ভাগ। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ যাত্রী চলাচল বৃদ্ধি পাবে। কার্গো ও যাত্রীবিমানের ফ্লাইট বেড়ে যাবে। বৈদেশিক বিনিয়োগের পাশাপাশি পর্যটন খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের জিডিপি বৃদ্ধি তথা দারিদ্র্য হ্রাসে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখবে। এসব বিষয় প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হবে।
বেবিচক সূত্র জানায়, প্রায় ১০ বছর আগে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নতি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় বসতভিটা উচ্ছেদ-সংক্রান্ত জটিলতায় সময় দীর্ঘ হচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যেই দ্বিতীয় পর্যায়ের অত্যাধুনিক রানওয়ে সম্প্রসারণের প্রকল্প নেওয়া হয়। আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার পাশাপাশি সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আকাশপথে দ্রুত যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা থেকেই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। বিমানবন্দরের বর্তমান ৯ হাজার ফুট দীর্ঘ রানওয়েকে মহেশখালী চ্যানেলের দিকে আরো এক হাজার ৭০০ ফুট সম্প্রসারণ করে ১০ হাজার ৭০০ ফুটে উন্নীত করা হয়। সম্প্রসারিত হতে যাওয়া ১৭০০ ফুট রানওয়ের ১৩০০ ফুটই থাকবে সাগরের পানির মধ্যে।
বেবিচকের প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ বোয়িং-৭৭৭-৩০০ ইআর, ৭৪৭-৪০০ ও এয়ারবাসের ৩৮০-এর মতো উড়োজাহাজ সহজেই ওঠানামা করতে পারবে। প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ৭৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। যার পুরোটাই অর্থায়ন করছে বেবিচক। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর কক্সবাজার হবে চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এটি আামাদের স্বপ্নের প্রকল্প। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ১০ হাজার ৫০০ ফিট। কক্সবাজারের কাজ শেষ হলে ঢাকা হয়ে যাবে দ্বিতীয় বৃহত্তম রানওয়ে। সমুদ্রে যতটুকু রানওয়ে যাবে, সেখানে পানিতে ব্লক, জিওটিউবসহ অন্যান্য সামগ্রী ব্যবহার করে বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে। প্রথমে আমরা চেয়েছিলাম রানওয়েটি শহরের দিকে সম্প্রসারণ করা যায় কি না। তাছাড়া শহরের দিকে করলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনা বিমানবন্দরের দিকে চলে আসবে। এতে অনেকেই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। এসব ভেবে পরে সমুদের দিকে চূড়ান্ত করা হয়েছে। সূত্র : আমার দেশ