- বাসের হেলপার থেকে আওয়ামী লীগ নেতা
- কক্সবাজারে ২৫টি অ্যাম্বুলেন্সে করে পাচার হতো ইয়াবার চালান
- কৃষক বাবার নামে স্কুল
- মাদরাসাসহ গড়েছেন বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি
নিউজ ডেস্ক : কক্সবাজার জেলার এক নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে রুস্তম আলী। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা থেকে তিনি এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। আর এই টাকার উৎস মূলত মাদক চোরাচালান। স্বেচ্ছাসেবক লীগের পদ পাওয়ার পর মাদকের সিন্ডিকেট গড়ে রুস্তম আলী বনে গেছেন বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির মালিক। তবে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গা-ঢাকা দিয়েছেন রুস্তম। তার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরাসরি গুলি করার অভিযোগে মামলা রয়েছে। পরিচিতদের দাবি তিনি সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে তিনি দেশে না থাকলেও তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ইয়াবার চালান থেমে নেই। সম্প্রতি কক্সবাজারে গিয়ে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পাগলীর বিল পালং ইউনিয়নের হলুদিয়া গ্রামের বাসিন্দা রুস্তম আলী। তার বাবা কৃষক মরহুম বাছা মিয়া। রুস্তম ২০০০ সালে বাসের হেলপার হিসেবে কাজ করতেন। ২০০২ সালে কক্সবাজারে বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে বয় হিসেবে কাজ করেছেন। এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ নেতা ও সোনালী ব্যাংকের পরিচালক এবং সাবেক এমপি সাইমুম সারওয়ার কমলের সাথে পরিচয় হয় তার। তখন থেকেই এমপির ঘনিষ্ঠ হিসেবে কাজ শুরু করেন রুস্তম আলী। সাবেক এমপি কমল সোনালী ব্যাংকের দুর্নীতির টাকা রুস্তমের মাধ্যমে বিদেশে পাচার শুরু করেন।
এই সুযোগে কমলের অবৈধ টাকায় রুস্তম এলাকায় মাদকের সিন্ডিকেট তৈরি করে ফেলেন। ইয়াবা পাচারের জন্য ২৫টি অ্যাম্বুলেন্স কিনে তাতে রোগী সাজিয়ে লাখ লাখ পিস ইয়াবা পাচার করে আসছিলেন রুস্তম ও তার সিন্ডিকেটের লোকজন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তার।
ইয়াবা রাখার জন্য রুস্তম রামু উপজেলার খুনিয়া পালং এলাকায় সাত কোটি টাকা ব্যয় করে লবস্টার নামে বিশাল কমিউনিটি সেন্টার গড়ে তোলেন। সেটাই মূলত ইয়াবার গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করতেন রুস্তম ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা। ২৫টি অ্যাম্বুলেন্সও রাখা হতো সেই সেন্টারে। এলাকায় ইয়াবা নিয়ন্ত্রণের জন্য রুস্তমের আস্থাভাজন হিসেবে নিয়োগ দেন আব্দুল্লাহ বিদ্যুৎকে।
স্থানীয়রা জানান, আব্দুল্লাহ বিদ্যুৎ এক সময় মাছের ঘেরে বিদ্যুতের মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন। ইয়াবা কারবার পাকাপোক্ত করতে বিদুৎকে ৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি করা হয়। রুস্তমের টাকায় প্রায় দুই কোটি টাকা খরচ করে তাকে ইউপি সদস্য (মেম্বার) নির্বাচিত করা হয়। বর্তমানে রুস্তম বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলায় পলাতক থাকলেও আব্দুল্লাহ ও রুস্তমের সহযোগীরা রয়েছে বহাল তবিয়তে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন মেম্বার আব্দুল্লাহ। বর্তমানে রুস্তমের সম্পদ দেখাশোনা করছেন আব্দুল্লাহসহ মাদক সিন্ডিকেটের লোকজন।
সম্প্রতি কক্সবাজারের রুস্তমের গড়ে তোলা ‘আলির জাহান’ নামে পাঁচতলার বিশাল বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে সেখানে একজন কেয়ারটেকার বসা। জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাড়িটির মালিক রুস্তম স্যার। তিনি কোথায় জানতে চাইলে বলেন, শেখ হাসিনা পালানোর সাথে সাথে স্যারও পালিয়েছেন। বাড়িটিতে ভাড়াটিয়া থাকায় ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। তবে এলাকার লোকজনের কাছ থেকে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রুস্তমের প্রভাবে এক সময় কক্সবাজারের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও ভয়ে থাকতেন। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে সে আওয়ামী লীগ কর্মী হলেও তাকে মামলার ভয়ভীতি ও পদ-পদবি খেয়ে ফেলার হুমকি দিতেন। মাদক কারবার, জমি দখল ও চাঁদাবাজি করে রুস্তম কক্সবাজার শহরে আবাসিক হোটেল নামে-বেনামে ক্রয় করেছেন।
এ ছাড়াও তার নিজ এলাকায় ধনীদের মধ্যে সেরা পাঁচজনের মধ্যে রুস্তম একজন। তার সাথে আরেক ইয়াবা ডন সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদির সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল। সৌদি আরবের মক্কায় টেকনাফের সাবেক এমপি বদির সাথে রুস্তমের যৌথ হোটেল ব্যবসা থাকায় টাকা পাচার ও ইয়াবা কারবারে পথ সহজ হয়ে যায় বদির সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণে রুস্তমের বিরুদ্ধে ভয়ে কথা বলতেন না স্থানীয়রা। কক্সবাজারে অনেককে জিম্মি করে জমি লিখে নিয়ে নিঃস্ব করেছেন রুস্তম।
এদিকে ঢাকায়ও রুস্তমের প্রভাব এবং মাদকের বিস্তার ছিল। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করেন রুস্তম। ঢাকায় ইয়াবার সিন্ডিকেট গড়ে অন্তত অর্ধশত ফ্ল্যাট নামে বেনামে ক্রয় করেন। ঢাকায় জমি ক্রয় করে সেই জমিতে ভবনও নির্মাণ করেছেন বলে এলাকাবাসী জানান।
রুস্তমের সিন্ডিকেটে রয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত কক্সবাজারের চাকমারকুল এলাকার সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম শিকদার, রাজারকুল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা জাফর আলম চৌধুরী। এলাকাবাসী জানান, কক্সবাজারে সাবেক এমপি বদি ও তার ভাইদের হাত ধরে রুস্তম মিয়ানমার থেকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ নবীর (বর্তমানে কারাগারে) সাথে রুস্তমের যৌথ ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনা করত।
নবী ছিলেন মিয়ানমার-বাংলাদেশের একমাত্র মাদক কারবারি ও অস্ত্র কেনাবেচার মূল হোতা। নবী গ্রেফতার হওয়ার পর তারা আরাকান আর্মির মাধ্যমে মাদক পাচারের সাথে চুক্তি করে রুস্তমের সিন্ডিকেট।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মিয়ানমারের আরাকান আর্মি বর্তমানে ইয়াবার ভ্যাট দশগুণ বাড়িয়ে দেয়ার কারণে ইয়াবার চাহিদা আরো বেশি দেখা দেয়ায় রুস্তম সৌদি আরব থেকে তার সিন্ডিকেটের হোতা মেম্বার আব্দুল্লাহসহ অন্যদের মাধ্যমে মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। ইয়াবা বিক্রির টাকা হুন্ডি ও মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে চলে যায় রুস্তমের কাছে।
কক্সবাজারে সরেজমিন কথা হয় স্থানীয় এক মাদক কারবারির সাথে। তিনি নাম প্রকাশ না করে বলেন, দিনমজুর আজিজুল হক, যিনি ডিভাইন গ্রুপের মালিক। ঢাকার বনানীতে কার সিকিউরিটিরও মালিক তিনি। কার সিকিউরিটিকে মূলত ইয়াবা গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সে রুস্তমের ঢাকার ইয়াবা ডিলার ছিল। সেও বর্তমানে দুবাইয়ে পলাতক আছে।
মিয়ানমার থেকে আনা মাদক কক্সবাজার হয়ে বনানীর আজিজুলের গোডাউনে চলে যেতো। সেখান থেকে ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে ইয়াবা। মাদকের চালান কক্সবাজার থেকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে প্রশাসনিক সহায়তা করতো কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম। কক্সবাজারের আওয়ামী লীগের নেতাদের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচারে জড়িত ছিল আজিজ ও রুস্তম।
সাবেক এমপি সাইমুম সারওয়ার কমলের পিএস আবু বকর (বর্তমানে ছাত্রহত্যা মামলায় গ্রেফতার) রুস্তমের সহযোগী হিসেবে ইয়াবা কারবারের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো: সাইফুদ্দীন শাহীন বলেন, আমি এই জেলায় নতুন এসেছি। তিনি বলেন, ইয়াবার সাথে যেই জড়িত থাকুক না কেন কোনো ছাড় নয়। রুস্তম ও তার সহযোগীরা যদি মাদকের সাথে জড়িত থাকে তাহলে অবশ্যই তাদেরকে আইনের আওতায় আসতে হবে। সূত্র : নয়াদিগন্ত